ডাকিনী পর্ব২

ডাকিনী পর্ব ২
 সানজিদা সুলতানা সুমা
১ম পর্বের পর......
আমি আম্মুকে আলেসের ব্যাপারে কিছুই বললাম নাহ। শুধু বললাম আম্মু, তোমাকে খুব মিস করছি তাই চোখে জল চলে আসছে। আম্মু কিছুক্ষণ আমাকে খুটিয়ে দেখে একগাল হেসে বলল পাগলী মেয়ে আমার। চিন্তা করিস নাহ। আগামী উইকএন্ডেই আমি তোর নতুন বাসায় বেড়াতে আসব। আমাকে দাওয়াত দিবি তো? আমিও খানিক হেসে বললাম নাহ। তোমাকে দাওয়াত দেওয়ার কি আছে? তোমাকে তো কোলে করে আমার বাড়িতে নিয়ে আসব। এভাবে আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে একসময় মন ভালো হয়ে গেল। সেদিন আর আলেসের ডায়েরি পড়িনি। পাছে যদি আবার মন খারাপ হয়ে যায়। একটা কমেডি মুভি দেখে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল আবার অফিসে যেতে হবে।
সেরাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম আমার কর্টেজের পেছনে কুয়োর পাশেই একটা মাঝারি ক্যাম্পফায়ারের মতো অগ্নিকুণ্ড যা জ্বলতে জ্বলতে একসময় একটা নারীমূর্তির আকৃতি ধারণ করলো, আর পর একটা কর্কশ চিৎকার, আর অগ্নিকুণ্ডটা দপ করে নিভে গেল।
পরদিন সকালে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে বাথরুমের আয়নায় চোখ পড়লো। ধুলি মাখা আয়নায় কে যেন ছোট ছোট হস্থাক্ষরে পোলিশ অক্ষরে সাইন দিয়েছে আলেস। চমকে দুপা পিছিয়ে আসলাম। তারপরে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে আয়নায় ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম ওখানে কিছুই লিখা নেই। পুরোটাই ধুলি মাখা। আপন মনেই হাসতে লাগলাম। বুঝলাম এসব অচেতন মনের ফালতু কল্পনা। সেদিন অফিসের শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে বিকালেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার মাসিক শুরু হয়েছিল তাই আরো বেশী ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বিকালে সূর্যালোক থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই কর্টেজের কোন বাতিই জ্বালাই নি। রাত ঘনিয়ে এলে কর্টেজটা অন্ধকারই থেকে যায়। মাঝরাতে একটা করুণ কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। অন্ধকার রুমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। কিন্তু মনে হচ্ছিলো কান্নাটা আমার পাশের লাইব্রেরী থেকেই আসছে।হাতড়ে হাতড়ে রুমের আলো জ্বালিয়ে গেলাম পাশের লাইব্রেরীতে। যাওয়ার সময় আমার ডেজার্ট ঈগল পিস্তলটা সাথে নিলাম। ভাবলাম হয়তো কর্টেজে কোন নেকড়ে ঢুকেছে। রাতে মাঝেমধ্যে নেকড়ের ডাক অনেকটা মানুষের কান্নার মতোই মনে হয়। তাই আমি ঝুকি নিতে চাই না। আমার রুম থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কান্নার আওয়াজটা থেমে গেল। লাইব্রেরীতে গিয়ে আলো জ্বালালাম। লাইব্রেরীতে কিছুই নেই। তবে গতকালের বাইবেলটা ডেস্কে খোলা পড়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম গতদিন আলেসের যে দুই পাতা আমি পড়েছিলাম তার পরবর্তী পাতা অর্থাৎ তৃতীয় পাতা বেরিয়ে আছে। যেন আমার পড়ার অপেক্ষায়। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল আমি বাইবেলটা বন্ধ করে শেলফে তুলে রেখেছিলাম, কিন্তু আজ এটা ডেস্কে এলো কিভাবে? ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে বাইবেলটা তুলে আলেসের লেখাগুলি পড়তে শুরু করলাম। ও লিখেছে “আজ হঠাৎ করে আমার সেলের দরজা খুলে, আমার সমবয়সী এক নগ্ন মেয়েকে ছুড়ে ভেতরে ফেলা হল। রক্ষীরা চেঁচিয়ে বলল, “দুই ডাকিণী একসাথে মর।” ওরা যতবারই আমাকে ডাকিণী বলেছে আমি উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এবার আমি নবাগত মেয়েটিকে দেখে খানিকটা আভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটা এক কোথায় অপরূপা সুন্দরী। মুখের ছলে যাওয়া চাবুকের দাগ কিংবা সারা শরীরের নির্যাতনের চিহ্ন তার সৌন্দর্য্যকে এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। ও বার দুয়েক মাথা তুলার চেষ্টা করতেই জ্ঞান হারালো। আমি ওর কাছে যেয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। ওর অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। ওর মাথার পেছনে বড় একটা ক্ষত যা থেকে তখনো রক্ত বেরুচ্ছিল। আমি আমার কোটিবন্ধনী দিয়ে ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিলাম। এই শীতে অসুস্থ মেয়েটাকে ধুকেধুকে মরতে দেখে আমার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠলো। চাবুকের অসংখ্য আঘাতে আমার নিজের কাপড়ই ছিড়ে একাকার। তবুও যতটা সম্ভব ওকে আমার কোলে জড়িয়ে রেখে গরম রাখার চেষ্টা করলাম। দেয়ালে টাঙ্গানো একটা মশাল এনে ওর পাশে পুঁতে দিলাম। ওকে কোলে নিয়েই এখন লেখতেছি। মশালের আলোয় ওকে আরো অপূর্ব লাগছে। আমাকে ক্ষমা কর ঈশ্বর। আমি তোমার এই অপরূপ সৃষ্টির প্রেমে পড়ে গেছি। ”
এই পৃষ্ঠা পড়ে বুঝলাম আলেস এক নারী সমকামী ছিল। ওই মেয়েটার সহচর্য এই নিদারুণ বন্দিত্বেও ওর হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার তোলেছিল। অথবা হয়তো ও সমকামী ছিলনা কিন্তু পরিস্থিতি ওর মনে খানিকের মোহের সৃষ্টি করে। কিন্তু নতুন মেয়েটার নাম কি ছিল? প্রশ্নটা আমার মাথায় আসতেই লাইব্রেরীর দরিজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। ধুলি মাখা দরজার কপাটে আলেসের সুস্পষ্ট হস্থাক্ষরে একটা নাম ফুটে উঠলো, “মার্টিনী।” ক্ষানিক পরেই তা আবার ধুলায় মিলিয়ে গেল। এবার প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আলেস মরে গিয়ে আমার কর্টেজে আটকে পড়েছে। আজ এই লাইব্রেরীতে ও আমার সাথে আছে। কিন্তু আমি ওকে দেখতে পারছি নাহ। এটা ভাবতেই আমার ঘাড়ের সবকটি লোম দাড়িয়ে গেল! প্রচন্ড ভাবে ঘামতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই বদ্ধ ঘরে কোথা থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে বাইবেলের পৃষ্ঠা উল্টে আলেসের লেখা পরবর্তী পৃষ্টায় নিয়ে গেল। বুঝলাম আলেস চাইছে যেন আমি ওর লেখা পড়ি। আমার মনে হলো ও দরজা আটকে আমার পালানোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যদি আমি ওর ইঙ্গিত না শুনি তবে এই বদ্ধ লাইব্রেরীতে ও হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে। ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকালাম। দরজায় আবার লেখা উঠলো, “সাহায্য কর বন্ধু। ” তারপর আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল। দরজা খুলে যাওয়ায় আমার মনে কিছুটা সাহস ফিরে আসলো। আলেস আমাকে বন্ধু বলে সম্বোধকরেছে! ওর সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু কেন? শেষ মেষ কি হয়েছিল ওর ভাগ্যে। এসব কৌতুহল আমাকে ওর পরবর্তী পৃষ্ঠা পড়তে বাধ্য করল। সেখানে লেখা ছিল,
“আজ সকালে আমার কোলেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরলো। আমি ওকে শুভ সকাল জানালাম। কিন্তু ও ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তন্মধ্যে রক্ষীরা চলে আসলো। আমাকে এখানে নিয়ে আসার তৃতীয় দিনের মাথায় ওরা প্রথম আমাকে খাবার দিলে। খাবার বলতে ছিল চার টুকরো বাসী পঁচা রুটি আর এক মশক পানি। আমি দুটুকরো রুটি ঐ মেয়েটাকে দিয়ে দিলাম। ও বুভুক্ষুর মত গোগ্রাসে গিললো। খাবার শেষে পানিটুকু আমরা দুজন ভাগ করে খেলাম। স্রষ্টাকে অসংখ্য ধন্যবাদ উনি অভুক্তদের খেতে দিয়েছেন, তৃজ্ঞার্তদের পান করিয়েছেন। আমি এবার মেয়েটার কাছে গিয়ে ওর মাথার ক্ষতটা দেখলাম। সারতে অনেক দেরি হবে মনে হচ্ছে। তবে সেরে যাবে। খেয়াল করলাম ওর নগ্ন দেহে ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে গেছে। সারারাত জ্বলতে জ্বলতে মশালটাও নিভে গেছে। ও ঠান্ডায় মারা যেতে বসেছে। ওকে আবার আমার কোলে নিয়ে আসলাম। প্রথমে বাধা দিলেও এক সময় ও বাধ্য হয়েই এসে আমার কোলে বসল। আমার ছেড়া কাপড়টুকু আমি আমাদের দুজনের দেহের উপর টেনে দিলাম। ও আমার বুকে মাথা গুজঁলো। ও খানিকটা স্থির হলে আমি ওর সাথে কথা বলতে শুরু করিলাম। ও জানালো তার নাম মার্টিনী গুয়েন্থার। ও নিমেসুয়েরার পাহাড়ি গ্রামে থাকতো। ওর বাবা একজন ভেষজ চিকিৎসক। ওর বাবাকে স্থানীয় গীর্জার প্রিস্ট খুন করে। তার অপরাধ ছিলো সে একজন পানিতে ডুবা ছেলেকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। ছেলেটার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও ওর বাবা ছেলেটাকে বুকে হাত দিয়ে চেপে বাঁচিয়ে ফেলে। প্রিস্টের মতে ছেলেটা মারা গিয়েছিল। কিন্তু ওর বাবা ছেলেটিকে মৃত্যুর ওপার থেকে কালোজাদুর মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছে। এর অপরাধে প্রিস্ট ছেলেটি ও মার্টিনীর বাবাকে শুলে চড়ায়। মার্টিনীকে ডাইনি আখ্যায়িত করে একরাত উলঙ্গ করে বরফে বেধে রাখে। পরদিন ওকে এখানে নিয়ে এসে …… মার্টিনী আর বলতে পারছিলো না। ও ফোঁপিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বুঝে গেলাম প্রিস্ট ওকে সারাদিন ভোগ করে রাতে আমার সেলে ছুড়ে ফেলেছিলো। আমি মার্টিনীকে আরো শক্ত করে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর ও ঘুমিয়ে পড়লো।আমি ওকে কোলে নিয়েই আবার লিখতে শুরু করলাম। " পৃষ্ঠাটা উল্টাতে গিয়ে খেয়াল হল ওটার অর্ধেকটা আমার চোখের পানিতে ভিজে গেছে। মনের মধ্যে ওসব ধর্ম ব্যাবসায়ী প্রিস্ট পাপিস্টদের প্রতি তীব্র ঘৃনা অনুভব করলাম। তখনই বেডরুমে আমার ফোনটা বেজে উঠে। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আমার রুমে ঢুকে ফোন ধরলাম। আম্মু ফোন দিয়েছে। আবার আম্মু আমাকে কাঁদতে দেখে ফেলল। জিজ্ঞাস করল আমার বাগদত্তার সাথে কোন সমস্যা হয়েছে কি নাহ। আম্মুকে উল্টাপাল্টা বলে আমি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম। আম্মুর সাথে কথা শেষে চোখমুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকলাম। বেসিনে নীচু হয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে যখন মাথা তুললাম তখন আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব ছিলো নাহ। ওটা অন্য একটা মেয়ে ছিলো। আমার অনুভব করলাম এটাই আলেস। আয়নার ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সহ্য করতে পারলাম নাহ। চিৎকার করে বাথরুমে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।

চলবে..........

Comments

Popular Posts