প্রবাসী রবিণ ও তাহার জন্মভূমি

প্রবাসী রবিণ ও তাহার জন্মভূমি
  রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

রবিণ। সীমান্ত প্রদেশ হতে সীমান্তের পথে 
যাইতে হইল দেখা স্বদেশের সাথে 
ভাবিয়া মায়ের মুখ উথলি উঠিল বুক, 
চলিলাম নত শিরে না দেখিনু চেয়ে 
জননী কহিল তবে সম্মুখীন হয়ে- 
(স্বদেশের উক্তি) 
'রবিণ নীরব কেন এতদিন ধরি? 
গাওরে বিহগ, গান প্রাণ মুগ্ধ করি। 

বারেক স্বদেশ পানে চাই অনুরাগে, 
বিদায় সঙ্গীত গাও বসন্তের রাগে।' 
(রবিণের উত্তর) 
জননি! করুণ স্বরে কেন ডাক আর 
'অনুরাগে, নিজপানে চাহ একবার?' 
ও কথা আবার প্রাণে, অতীতের স্মৃতি আসে 
পরাণ গলিয়া চোখে বহে শত ধার। 
কি বলিব পোড়া মুখ, বলি কিন্তু বড় দুঃখে 
চাহিতে তোমার পানে পারি না আর। 

এখন হয়েছ তুমি তস্করের লীলাভূমি 
আমাদের বাসযোগ্য নহ তুমি আর। 
পাথর পাতকী সব এবে অধিবাসী তব, 
হৃদয় বিদরে হেরি দুর্গতি তোমার। 
কোথা তব ধর্ম নীতি, কোথা সে শান্তি প্রীতি? 
এবে তুমি জনয়িত্রী মায়া ছলনার। 
কেন মা! করুণ স্বরে ডাকিলে আবার? 
বড় জ্বালা মাতঃ বিদেশে এসেছি, 
বড় দুঃখে জননী গো। তোমায় ত্যজেছি। 

সেই স্নেহপূর্ণ ভোর, বিজন অরণ্য ঘোর, 
তেমন মুখর স্থান কোথা কি দেখেছি? 
কি যে সুখ ছিল তায় বলিতে পারিনা হায়। 
ওই মাতৃকোলে বসে স্বরূপ ভুলেছি। 
পেয়ে ঐ মাতৃবুক ভুলেছি বেদনা দুখ, 
কুটীরে থাকিয়া মাগো! প্রসাদ ভেবেছি। 
জনম ভূমিরে হায়! সহজে কি ছাড়া যায়? 
স্বর্গাধিক গরীয়সী তোমারে জেনেছি। 
পাষণে বাঁধিয়া মন, সেই রম্য তপোবন 
তোমার স্নেহের কোল, তবু যে ত্যজেছি। 
বড় জ্বালা পেয়ে মাগো! বিদেশ এসেছি। 

সেই লতা পাতা ঘেরা ছোট নীড়খানি, 
চারদিকে বিভীষণ শ্যাম অরণ্যানী, 
খল, দস্যু ও তস্কর শার্দ্দুলাদি নিশাচর, 
নানারূপে নিপীরন করিত। জননি! 
সেই যে নিষ্ঠুর রাতে প্রাণটুকু নিয়ে হাতে 
অনিদ্রায় জাগিতাম সারাটি রজনী 
অবশেষে যে সময় নিতান্ত অসহ্য হয়, 
তখন আসিনু ছাড়ি তোর বুকখানি 
সেই লতা পাতা ঘেরা স্নেহ নীড়খানি। 

'রবিণ নীরব কেন এতদিন ধরি?' 
কি গান গায়িব মাতঃ! প্রাণ মুগ্ধ করি? 
সে কোমল ফুল্ল প্রাণে সংসারের বিষবাণে 
শত ছিদ্র হইয়াছে--তাই জ্বলে মরি। 
এবে দেখি সমুদয় অনল গরলময়, 
সুখের সঙ্গীত তাই গিয়াছে বিস্মরি! 
সেদিনের সুধাকরে আজি হলাহল করে, 
সে সৌন্দর্য্য নাই ভবে কি হইল? বুঝি তবে 
বিগত শৈশব সব লয়ে গেছে হরি। 

এখন পরাণ যেন হয়েছে মরুভু হেন, 
দুখের সঙ্গীত গায় হৃদি দীর্ণ করি। 
শুনি সে করুণ গীতি মনে কি পাইব প্রীতি, 
হইবে কি সুখী মাতঃ! আপনা পাসরি? 
রবিণ নীরব তাই এতদিন ধরি! 
যাও মাতঃ চলি, আর পথ রোধিও না, 
নীরবে সরিয়া যাও, কথা কহিও না। 

করুণা মমতা রাশি আবার উঠিবে ভাসি। 
কাজ কি? নিবানো বহ্নি আর জ্বালিও না। 
বলিয়ে স্নেহের কথা মরমে দিওনা ব্যথা 
নিদ্রিত স্মৃতিরে জাগায়ে দিও না। 
আমি দীর্ঘশ্বাস আর মুখপানে বার বার 
করুণ নয়নে মাগো! পুণ্য চাহিও না 
যাও মা! নীরবে চলি পথ রোধিও না। 

Comments

Popular Posts