স্মৃতির চাঁদর

স্মৃতির চাঁদর
    শাকিল মাহমুদ্
শৈশবের স্মৃতি  যেমনভাবে আমাদের হাঁসায় তেমনিভাবে
আমাদের কাঁদায়ও।বললে ভুল হবে না,শৈশবের প্রত্যেক পরতে পরতে আনন্দঘন মুহূর্ত লুকায়িত ছিল।এখনো মনে পড়ে যাদেরকে, তারা হয়তো দূরে থেকে বহু দূরে।কেউ চলে গেছে এ দুনিয়ার মায়া কান্না ত্যাগ করে আর যারা আছে তাদের সাথে দেখা হওয়া কখনো হবে কিনা জানা নেই।মনে পড়ে প্রথম দাদার হাতে মার খাওয়া,মনে পড়ে সারাদিন জঙ্গলে লুকায়িত থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা সাথে মায়ের বকুনি দাদার ভালবাসা,মনে পড়ে প্রথম স্কুলে যাওয়া।নাসরিন ফুফু,জেসমিন ফুফু,বড় আপু,ছোট আপুদের সাথে হাড়ি-পাতিল খেলা।সব কিছুই মনে পড়ে অবশ্য মনে পড়ার মতোই।
মনে পড়ে আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম এবং ঘুমাচ্ছিলাম জাকির কাকার কোলে আর মহিব ভাইয়া আমকে জুসে পরিবর্তন
করে আমায় খাওয়াচ্ছে,এখন হয়তো আর কখনো জাকির কাকার কোলে ঘুমানো ও মহিব ভাইয়ার হাতে
আম খাওয়া হবে না।কারন তারা তাদের বয়সের সিঁড়ি পার করেছে আমি ও আমার বয়সের সিঁড়ি পার করেছি,এখন ওগুলো স্মৃতি হিসাবেই থাকবে।
যখন প্রথম ঢাকায় আসি বাবার হাত ধরে,
একলা আমি সর্বদা বসে থাকতাম জানালার কোলটি
ঘেঁষে। আমি আমার ভিতর ছিলাম না,দেহ এখানে থাকলেও মনটা পড়ে রইতো গ্রামের সবুজ ছায়ায়।শেষ পর্যন্ত সেই গ্রামেই ফিরে গেলাম,যেখানে আমার নারীর টান।
দাদার মৃত্যু,তখন সবাই আমরা ঢাকায়।মৃত্যু  কি জিনিস সেটা বুঝার আগেই চলে গেল দাদা।
তখন আমি বুঝবান হলেও অবুঝ ই ছিলাম।যে দিন রাতে দাদার মৃত্যু  হবে সে দিন একটা স্বপ্ন দেখে এ অবুঝ বালক;যেটার মানে সে বুঝতে পারে না যতক্ষন দাদার মৃত্যুর খবর না শুনে।যে স্বপ্ন দেখি," আমি লঞ্চের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অন্য একটি লঞ্চ আমাদের লঞ্চে ধাক্কা দেয়,
আমি সে ধাক্কা সামলে নেই এবং বেঁচে যাই কিন্তু হঠাৎ আরএকটি লঞ্চ এসে ধাক্কা দেয় যেটা আমি সামলাতে পারি না।আমি লঞ্চ থেকে পড়ে যাই।সকালে মাকে সবটা খুলে বলি,মা আমাকে শান্তনা দেয়।ঐ সময়টাতে বাবার মোবাইল ছিল না কিন্তু একটা জিপি সিম ছিল যেটা অপেক্ষায় ছিল একটা মোবাইল ফোনের।তাই ফোনের মাধ্যমে খবর আসা সম্ভব ছিল না।
তাইতো আলমগির কাকা ও সালাম ভাইয়া আমাদের নতুন ভাড়া বাসায় আসলো।আমাদের একটা ভাঙ্গা মড়া ছিল যেটা নিয়ে আমি খেলা করতাম,সালাম ভাইয়া ঐ মড়াটাতে বসলো অমনি সে নিচে পড়ে গেল।এ দৃশ্যপাট দেখে রিমা আপু অট্টহাঁসিতে ফেটে পড়লো।কিন্তু পরক্ষনে কাকা যে খবরটা বললো তাতে আমাদের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা বিষাদ ছায়ায় ভড়ে গেল।তখন হয়তো দুচোখ বেয়ে লোনাজল বের হয়নি কিন্তু মনের গহিনে খুব করে ধাক্কা লেগেছিল।এখনও দাদার মতো কাউকে দেখলে তাকে দাদা বলেই ডেকে ফেলি।যখন দেখি কোন বাচ্চা দাদার হাত ধরে হাটছে বা স্কুলে যাচ্ছে তখন বুকের ভিতরটা হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলে,কখনো হয়তো দাদার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া হয়নি কিন্তু দাদার অকৃত্তীম ভালবাসাটা আমি পেয়েছি।আমার ঐ সকল বাচ্চার প্রতি হিংসা হয়,যাদের দাদা-দাদি এখনও জিবিত।
এখনও দাদির পরশমাখানো হাতখানা ভুলতে পারিনি,মনে হয় এইতো সে দিন দাদি আমার পাশে বসে ছিল আর হরেক-রকম গল্প বলছে।আমি দাদি বড্ড সাদা-সিধে মানুষ ছিল,মানুষকে খুব তারাতারি আপন করে নেওয়া তার কাছে মেয়েখেলা ছিল।দাদির সামনে বাবা কখনোই আমাকে মারতে পারেনি,দাদি বাবার হাতের লাঠি কেড়ে নিয়ে বলতো,"মারলে আমায় মার,তবুও আমার নাতির গাঁয়ে একটা আঁচড় পরতে দিবো না।
মনে পড়ে;দাদির সাথে শোয়ার জন্য দুই বড় বোনের সাথে তমুল ঝগড়া,দাদির নরম চামড়া ধরে টানাটানি করে কতো যে আনন্দ পেতাম সেটা কখনো ভুলবার নয়।দাদি তোমার কাছে মাফ চাই,জানি তুমি মাফ করেছো তবুও।
দাদির যখন পা ভাঙ্গে তখন আমরা গ্রামে,দাদির পা টাও গ্রামে বসে ভেঙ্গেছিল তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়।দাদিকে দেখতে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি,আমার বড় ফুফাতো বোন(বড় আপা)খুব মজার ও মিশুক একজন মানুষ এখন হয়তো বয়সের বাড়ে কঠিন হতে হয়েছে তাইতো ইরা আপু আজ ডাক্তারি পড়ছে।বড় আপা আমাকে অনেক অনেক খাবার কিনে দেয়,যা দেখে আমি অভূতপূর্ব হয়ে যাই।গ্রামের ছেলে হিসাবে এতগুলো খাবার কখনো দেখিনি তাইতো অধিক আনন্দিত হয়েছিলাম;কবি বলে"আনন্দ মানুষকে যতটা হাঁসায় পরবর্তীতে তার অধিক কাঁদায়"আমার বেলায় ও সেটাই হয়েছে আমার খাবারগুলো আফিফ চুরিকরে খেয়ে ফেললো,না সব না অনেকটা।অবশ্য ও তখন ছোট।
মনে পড়ে,গ্রামে সবাই যেত।তাদের থেকে দ্বিগুন আনন্দিত হতাম আমি।এখন আর কখনো একসাথে গ্রামে যাওয়া হয় না,সবাই সবার কাজে ব্যস্ত।
এখন আর কাকাতো-ফুফাতো ভাইবোনরা একসাথে লুকাচুপি খেলা হয় না।এখন আর সৌরভ ভাইয়া,মাছুম ভাইয়ার কাছে গল্প শোনা হয় না। এখনো দাদাবাড়ি ডাকছে হাতছানি দিয়ে এসো ফিরে এসো তোমা বিহিন আমি শূন্য।
আমি আমার খালাতো ভাইদের ও খুব খুব মিস করি।
শহিদুল ভাইয়া একবার আমাকে একটা সবুজ কালার টি-শার্ট দিয়েছিল,যেটা আমার এত পছন্দ ছিল তাই একটানা দু মাস ঐ টি-শার্ট  আমি পরিধান করেছিলাম।
নানাবাড়ির কথাও কখনো ভুলবো না।ওটা আমার আর এক অন্তর। নানা-নানির ভালবাসা,ছোট মামানির ভালবাসা কখনো ভোলার নয়। ছোট মামানি আমায় খুব আদর করতো আমি যেটা খেতে চাইতাম সেটা এনেদিত আর একটা কথা বলতো,যেটা আমাকে রাগানোর জন্য বলা হতো কখনো ভুলবো না।
প্রতি বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে নানাবাড়ি যাওয়া হতো,আমরা ভাইবোনরা রিমা আপু,হিরা আপু,জেমি আপু,হাসান ভাইয়া,হাসিব ভাইয়া সবাই মিলে খেলা করতাম ও গল্প করতাম।একসাথে সব খালাদের দেখে মনটা আনন্দে ভরে যেত।মামাদের সাথে আমার তেমনটা জমেনি।ছোট মামার ভেটকি ও বড় মামার লাজুকতা দুজনকে অনন্য করেছে।ভালবাসার মানুষগুলো কেন যে পাল্টে যায় সেটা আমার জানা নেই।কিন্তু এ পালটানোই মানুষকে ভালবাসতে শিখায়,মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখায়।
ছোটবেলার আরো কতো সুন্দর সুন্দর স্মৃতি আছে তা আজ মনের ক্যানভাস থেকে মুছে গেছে।যেটুকু আছে সেটুকুও যেন মুছে না যায় তাই এ লেখা।আরো অনেক অনেক মানুষ আছে যাদের সম্পর্কে লিখা হয়নি তাই বলে তাদের কেও কম ভালবাসিনা,মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তোমাদের ভুলবো না।
আমার এক ছোট বোন বলেছে,"আমরা ভাইবোনরা আস্তে আস্তে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি,একসময় দেখা যাবে আমরা একে অপরকে দেখেও চিনতে পারবো না।"

Comments

Post a Comment

Popular Posts