কবিতার ক্লাস- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী





কবিতার ক্লাস নামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি জনপ্রিয় ও আলোচিত বই আছে,বইটি বৈশাখ ১৩৭৭ সালে প্রথম কলকাতায় প্রকাশ পায় পরবর্তীতে ডিসেম্বর ২০১০ সালে বইটি নবযুগ প্রকাশনীর হাত ধরে বাংলাদেশে প্রকাশ পায়।
সেই বইয়ের বিশেষ কিছু অধ্যায়ের বিশেষ কিছু কথা তুলে ধরার ক্ষুদ্র চেষ্টা। বইয়ের প্রথম অধ্যায়"কেউ কেউ কবি নয় সকলেই কবি"
লেখক বলেন,"আমার গিন্নীর খুড়তুতো ভাই সওদাগরি আপিসের বড়বাবু। আগে সেও কবিতা লিখত,কিন্তু আপিসে তাই নিয়ে হাসাহাসি হওয়ায়,এবং বড়সাহেব তাকে একদিন চোখ পাকিয়ে "হোয়াটস্ দিস্ আয়াম হিয়ারিং অ্যাভাউট য়ু" বলায়,
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে সে এখন গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত হয়েছে।তার কাছে সে-দিন একটা ইংরেজি বই দেখলুম।বইয়ের নাম "বুচার বেকার মার্ডার মেকার"। অর্থ অতি পরিষ্কার। যে কেউ খুন করতে পারে।নৃশংস কসাইও পারে,আবার নিরীহ রুটিওয়ালাও পারে।খুন করার জন্য  যে একটা আলাদা রকমের লোক হওয়া চাই,তা নয়।
তুলনাটা হয়তো একটু অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি।
কবিতার ব্যাপারেও তা-ই। কবিতা লিখবার জন্যে আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই।রামা শ্যামা যদু মধু প্রত্যেকেই
(ইচ্ছে করলে,এবং কায়দাগুলোকে একটু খেটেখুটে রপ্ত করে নিলে) ছন্দ ঠিক রেখে, লাইনের পর লাইন মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
তার জন্যে,বলাই বাহুল্য, কিছু জিনিস চাই,এবং কিছু জিনিস চাই না।আগে বলি কী কী চাই না।

[১ ] কবি হবার জন্যে লম্বা লম্বা চুল রাখবার দরকার নেই । ওটা হিপি হবার শর্ত হতে পারে , কিন্তু কবি হবার শর্ত নয় । পরীক্ষা করে দেখা গেছে , চুল খুব ছোট করে ছেঁটেও কিংবা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে ফেলেও কবিতা লেখা যায় । চুলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে , কবিতার নেই ।

 [ ২ ]সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই । পরীক্ষা করে দেখা গেছে , মাটির দিকে তাকিয়েও কবিতা লেখা যায় । সবচাইতে ভাল হয় , যদি অন্য - কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু খাতার দিকে চোখ রাখেন । 
 [৩ ]কখন চাঁদ উঠবে , কিংবা মলয় সমীর বইবে , তার প্রতীক্ষায় থাকবার দরকার নেই । পরীক্ষা করে দেখা গেছে , অমাবস্যার রাত্রেও কবিতা লেখা যায় , এবং মলয় সমীরের বদলে ফ্যানের হাওয়ায় কবিতা লিখলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না ।
  [ ৪ ] ঢোলা - হাতা পাঞ্জাবি পরবার দরকার নেই । পরীক্ষা করে দেখা গেছে , স্যানডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েও , কিংবা একবারে আদুর গায়েও , কবিতা লেখা সম্ভব । এইবার বলি , কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই । বিশেষ কিছু চাই না । 
  দরকার শুধু–
   [ ১ ] কিছু কাগজ (লাইন -টানা হলেও চলে,না হলেও চলে )। 
   [ ২ ] একটি কলম ( যে - কোনও শস্তা কলম হলেও চলবে ) অথবা একটি পেন্সিল । এবং
   [ ৩ ] কিছু সময় ।

কিন্তু এত সব কথা আমি বলছি কেন?কবিতার কৌশলগুলোকে সর্বজনের হাতের মুঠোয় এনে না  দিয়ে কি আমার তৃপ্তি নেই ? সত্যিই নেই । ইংরেজিতে ‘ পোয়ট্রি ফর দি কমন ম্যান ' বলে একটা কথা আছে । আমার ইচ্ছে , কমন ম্যানদেরও আমি পোয়্ট বানিয়ে ছাড়ব । পরশুরামের কথা মনে পড়ছে । তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল , পৃথিবীকে একেবারে নিঃক্ষত্রিয় করে ছাড়বেন । কিন্তু , না - পারবার হেতুটা যা - ই হোক , কাজটা তিনি পারতে পারতেও পারেননি । বিশ্ব - সংসারকে যাঁরা নিষ্কবি করে ছাড়তে চান ( অনেকেই চান ) , তাঁরাও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না ।

আমার প্রতিজ্ঞাটা অন্য রকমের । আমি ঠিক করেছি , বাংলাদেশে সব্বাইকে আমি কবি বানাব । দেখি পারি কি না । কবিতা লিখবার জন্যে কী কী চাই , তা তো একটু আগেই বলেছি । চাই কাগজ , চাই কলম ( কিংবা পেন্সিল ) , চাই সময় । তা আশা করি কাগজ - কলম আপনারা জোগাড় করতে পেরেছেন । বাকি রইল সময় । তাও নিশ্চয়ই আপনাদের আছে । রেশনের দোকানে লাইন না লাগিয়ে , এই যে আপনারা গুটি - গুটি ' কবিতার ক্লাস ' - এ এসে হাজির হয়েছেন , এতেই বুঝতে পারছি যে , সময়ের বিশেষ অভাব আপনাদের নেই ।


সুতরাং ' দুর্গা দুর্গা ' বলে শুরু করা যাক । অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু আগেই বলি , কবিতার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা চাই । কাব্যগুণ , ছন্দ , মিল । বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না , তেমনি কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না । তার প্রমাণ হিসেবে , আসুন , আমার সেই মাসতুতো ভাইয়ের ছোট ছেলের লেখা চারটে লাইন শোনাই :

"সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়া যে , 
  দুর্যোধনের ভাই । 
  গর্জনে তার ভূর্য বাজে , 
  তৰ্জনে ভয় পাই ।"

বলা বাহুল্য , এটা কবিতা হয়নি । তার কারণ , ছন্দ আর মিলের দিকটা ঠিকঠাক আছে বটে , কিন্তু কাব্যগুণ এখানে আদপেই নেই । এবং কাব্যগুণ না থাকায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা নেহাতই বাক্যের ব্যায়াম হয়ে উঠেছে । 
এবারে মিলের কথায় আসা যাক । মিল না রেখে যে কবিতা লেখা যায় না, তা অবশ্য নয় , তবু যে আমি মিলের উপরে এত জোর দিচ্ছি তার কারণ :
[১ ]প্রথমেই যদি আপনি মিল - ছাড়া কবিতা লিখতে শুরু করেন , তা হলে অনেকেই সন্দেহ করবে যে , মিল - এ সুবিধে হয়নি বলেই আপনি অ - মিলের লাইনে এসেছেন । সেটা খুবই অপমানের ব্যাপার । 
[২ ] মিল জিনিসটাকে প্রথম অবস্থায় বেশ ভাল করে দখল করা চাই । তবেই সেটাকে ছেড়ে দিয়েও পরে ভাল কবিতা লেখা সম্ভব হবে । যেমন বড় - বড় লিখিয়েদের মধ্যে অনেকেই অনেক সময় ব্যাকরণের গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়েও চমৎকার লেখেন , এও ঠিক তেমনি । ব্যাকরণ বস্তুটাকে প্রথমে বেশ ভাল করে মান্য করা চাই , তবেই পরে সেটাকে দরকারমতো অমান্য করা যায় । ঠিক তেমনি , পরে যাতে মিলের বেড়া ভাঙা সহজ হয় , তারই জন্যে প্রথম দিকে মিলটাকে বেশ আচ্ছা করে রপ্ত করতে হবে । ছন্দ কিন্তু সব সময়েই চাই । আগেও চাই , পরেও চাই । আসলে আমার ক্লাসে আমি ছন্দের কথাই বলব । সেই বিচারে ' কবিতার ক্লাস ' না বলে একে ' ছন্দের ক্লাস’ও বলা যেতে পারত । তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না ।

[যারা বই প্রেমী এবং কবিতা লিখতে পছন্দ করে বা লিখতে চায় তাদের উচিত বইটা পড়া]

সূত্রঃ 
বই:কবিতার ক্লাস- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

Comments

Popular Posts