শেষ চিঠি



শেষ চিঠি

লেখাঃশাকিল মাহমুদ




নতুন বাসা কেমন হয়েছে?
এ কেমন কথা , এ বাসা ভাড়া করলাম তো আমি নিজেই। মা তুমিই তো আজ প্রথম এলে।

অহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।বয়স হয়েছে তাই অনেক কথা ভুলে যাই,তাই তো তোকে সারাদিন বলি একটা বিয়ে কর।

সব কথা ভুলে যাও কিন্তু বিয়ের কথা তো ভুলনা ,আমাকে তাড়াতে পারলেই তুমি খুশি।
কি সব আবোল-তাবোল বকছিস, আমি কি এসব কথা কখনো বলেছি?
সব কথা কি বলা লাগে,মানুষের বাচনভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় তার মনে কি চলছে।
হয়েছে তোমাকে আর মনোবিজ্ঞানী হওয়া লাগবে না, এখন আমাকে ঘর সাজাতে সাহায্য করো।
সেটা আর হবে না আমাকে এখন কলেজ যেতে হবে,
গুরুত্বপূর্ণ একটা এক্সাম আছে।এখন তুমি সামলাও আমি রাতে এসে দেখছি।

কি হয়েছে তোমার,আমার সাথে এরকম কেনো করছো?
আমার তো কিছু হয়নি।যা হবার তা তো তোমার হয়েছে।
কি এমন হলো যে কারনে তুমি আমার উপর এত রেগে আছো?
কিছু না, আমার মনে হয় আমরা একে অপরের জন্য নই।আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।
আলাদা! মানে কি সব আবোল তাবোল বকছো তুমি।তোমার মাথা ঠিক আছে?তুমি এখন সোজা বাসায় যাও, তোমার মাথা ঠান্ডা হলে তোমার সাথে এ বিষয়ে পরে কথা বলবো।

কিরে তোর ফিরতে এত দেরি হল কেন?
আর বলোনা পরীক্ষা অনেক খারাপ হয়েছে।
তা তো হবেই কখনো বই খুলে দেখেছো, সারাদিন তো মুভি দেখা আর ঘুরতেই ব্যস্ত থাকা।
আচ্ছা এসব বাদ দাও,তুমি তো দেখি আমার জন্য কোনো কাজই বাকি রাখো নি।
আমার জানা আছে তোমার জন্য কাজ বাকি রাখা তারমানে ওগুলো শেষ পর্যন্ত আমাকেই করতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখন গোসল করতে গেলাম।
মার্গারেট শোন, একটা চিঠি এসেছে।
কার নামে?
সেটা তো জানিনা,চিঠির উপরে কিছু লেখা নেই। শুধু এ বাড়ির ঠিকানা লেখা।
এই বাড়ির ঠিকানা তো কেউই জানেনা তাহলে কে চিঠি লিখবে।
সেটা আমি কি করে বলব তুই হয়তো কাউকে বলেছিস, চিঠিটা পড়ে দেখ কে কি লিখেছে।
আচ্ছা গোসল করে এসে দেখছি।

"প্রিয়,
প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে যাই। কেমন যেন এক অদ্ভূত টান তোমার দিকে আমাকে আকর্ষিত করে। আসলে আমি তোমার সৌন্দর্য্যের প্রেমে পড়েছি নাকি তোমার প্রেমে পড়েছি সেটা এখনো বোধগম্য হয়নি।"

কিরে চিঠিতে কি লিখেছে?
এটা একটা প্রেমপত্র।
তোর কাছে প্রেমপত্র, তোমার মত খারুস কে কে প্রেমপত্র দিলো?
কারো নাম লেখা নেই। আর তুমি আমাকে খারুস বলছ কেন?
এরকম ফাটা বাঁশের মত চিৎকার করলে তোমায় আর কি বলবো।
তুমি এখন এখান থেকে যাও আর আমার মাথা খারাপ করোনা।

চার দিন পর কলেজে,
কিরে মার্গারেট তুই এখানে আনমনা মনে বসে আছিস কেন কিছু কি হয়েছে?
না কিছু হয়নি এমনিতেই বসে আছি।
কিরে তোর বয়ফ্রেন্ড কোথায় ওকে অনেকদিন দেখছি না।
তা কি করে বলবো।
কেন ওর সাথে কি তোর ব্রেকআপ হয়েছে।
না তেমন নয়, শুধু দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
ও যে আমায় বললো..
আমি ওর কথা শুনতে চাই না,কিছু বলতে চাইলে অন্য কিছু বল নাহয় এখান থেকে যা।
তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করছিস?
আমি আর মা নতুন বাসায় উঠেছি তা তো তুই জানিস।
হুম,তাতে কি হয়েছে?
নতুন বাড়িতে উঠতেই একটা চিঠি এলো, চিঠিটা পড়ে মনে হল একটি প্রেমপত্র। চিঠির ভিতরে কারো নাম লেখা ছিল না। কে পাঠিয়েছে বা কাকে পাঠিয়েছে কারো নাম নেই।
তাতে সমস্যা কি?
সমস্যা কিছুই ছিল না তারপর দ্বিতীয় দিন আর একটা চিঠি আসে।
তাতে কি লেখা ছিল?
ওই সে আমাকে খুব পছন্দ করে সে আমার প্রেমে পড়েছে এসব হাবিজাবি কিন্তু এখানেও তার নাম ছিল না এবং কাকে লিখছে তার নামও নেই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম চিঠিটা হয়তো আমাকে ই লিখছে কিন্তু কাল আরেকটি চিঠি এলো এবং তাতে লেখা ছিল।
কি ছিল?
এই নে তুই পড়।

"প্রিয় সোফিয়া,
কি অবাক হলে আমি তোমার নাম জানলাম কি করে। আজ অনেক কষ্টের পর তোমার নামটি জেনেছি। তোমার মত তোমার নামটিও খুব সুন্দর।
ইতি,
আমি"

কি অদ্ভুত চিঠি, ছেলেটার নাম আমি?
ধুর তুইতো মস্ত পাগল আমি তোকে যে জন্য চিঠিটা পড়তে দিলাম তুই সেটাই বুঝলি না।
কি?
চিঠির শুরুতে যার নাম লেখা সে আমি নই।
ওমা তাই তো দেখছি।সোফিয়া!এই সোফিয়াটা আবার কে?
তা আমি কি করে বলবো।

এলিনা একটা কাজ করলে কেমন হয়।
কি কাজ?
আমরা যার থেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছি তার কাছে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।
কেন?
আমার মনে হয় সোফিয়া মেয়েটি আমাদের আগে এই বাসায় থাকতো, তাই ছেলেটি এই ঠিকানায় চিঠি লিখছে। ছেলেটি হয়তো জানেনা সোফিয়া বাসা বদল করেছে।
তা তুই ঠিক বলেছিস, চল।

তোমরা কি বলো তোমাদের কাছে একটি চিঠি আসে সোফিয়ার নামে।
হ্যাঁ আঙ্কেল। সেটা কালকেই জানতে পেরেছি, যে চিঠিটা সোফিয়ার জন্য আসে। আঙ্কেল আপনি কি বলতে পারবেন আমরা কিভাবে সোফিয়ার সাথে যোগাযোগ করব।

বাবু সেটা তো আমি ঠিক বলতে পারছি না কারণ সোফিয়ার বাবা-মা আলাদা হয়ে গিয়েছে এবং তারা অন্য স্থানে শিফট হয়েছে। সোফিয়া ওর মায়ের সাথে আছে।
আঙ্কেল একটু দেখুন সোফিয়ার দেখা পাওয়াটা খুব দরকার।
আচ্ছা বাবু আমি সেটা দেখছি তোমরা এখন বাসায় যাও। ঠিকানা পেলেই আমি তোমাকে জানিয়ে দিব।

কিরে মার্গারেট তুই এত পাগল হচ্ছিস কেন সোফিয়া কে খুঁজতে। কি এমন লিখেছে আর তাই তুই সোফিয়াকে খুঁজতে পাগল। কিরে ব্যাপারটা কি?
আজকে আরেকটি চিঠি এসেছে।
কি বলিস, তাতে কি লেখা?
ছেলেটি সোফিয়াকে ছাড়া বাঁচবে না। তার জন্য সে সব করতে রাজি। আজ চিঠির সাথে একটা বইও এসেছে বইয়ের ভিতরে একটা শুকনো গোলাপ আছে আরো কত কি হাবিজাবি।
কি বলিস, কিসের বই?
শেক্সপিয়ারের রোমিও এন্ড জুলিয়েট।

আজ নিয়ে এক মাস পূর্ণ হলো চিঠি আসা কিন্তু এখনো আমি চিঠির লেখক এবং চিঠির আসল মালিকের খোঁজ পেলাম না।
ছেলেটির প্রত্যেকটি চিঠি যেন একেকটি সাহিত্যের পাতা, যতই ছেলেটির চিঠি পড়ছি ততোই ছেলেটির প্রতি আমার ভালোবাসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জানি এটা ঠিক নয় তবুও কেন জানি মনে হয় চিঠিটা যদি আমার জন্য আসতো হয়তো ভালোই হতো। অন্য একটা মেয়ের প্রতি একটি ছেলের এরকম ভালবাসা দেখে আমার খুব হিংসে হচ্ছে।কিন্তু আমি জানি চিঠিটা আমার জন্য নয় সোফিয়ার জন্য। যাকে আমি কখনো দেখিনি সে হয়তো আমার থেকেও বেশি সুন্দরী বা আমার থেকে কম। মনে হয় বেশিই হবে। না হলে কি একটি ছেলে এরকমভাবে ক্রমাগত চিঠি লিখে যায়।

আরো সাত দিন পার হয়ে গেল কিন্তু কারো কোন খোঁজ পেলাম না, আজও ছেলেটির চিঠি এলো ছেলেটি আমার সাথে দেখা করতে চায়, না আমার সাথে নয় সোফিয়ার সাথে। আজ চিঠিতে লেখা আছে সে কালকে চিঠিতে তার নাম এবং সে কোথায় থাকে সেটা লিখে পাঠাবে। শুধু সে আধাঘন্টা সময় চেয়েছে শুধুমাত্র কিছুক্ষণ কথা বলার জন্য ব্যাস এতোটুকুই তারপর সে আর কিছুই চায়না।


আজ রবিবার সরকারি ছুটির দিন আমি সকাল থেকে অপেক্ষায় আছি আজ একটি চিঠি আসবে সেই চিঠিতে আমার এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে আমি ছেলেটির নাম জানতে পারবো এবং কোথায় থাকে সেটাও জানতে পারব আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় আছি। হঠাৎ আমাদের ল্যান্ড লাইনে কল আসলো।
বাবু আমি তোমার আংকেল, তুমি যে একটি ঠিকানা চেয়েছিলে সেই ঠিকানাটা লিখে নাও।
আমি আকস্মিক আকাশ থেকে পড়লাম আমি চটজলদি ঠিকানাটা লিখে নিলাম। এলিনা এবং আমি সোফিয়ার উদ্দেশ্যে কিয়েভ শহরে পাড়ি জমালাম।

মার্গারেট আমাকে তুই একটা কথা বল।
কি বলবো।
তুই কখনো একটা ছেলের প্রতি এতটা দূর্বল হয়েছিস বলে তো আমার মনে হয় না।আর আমাকে সত্যি করে বলতো তুই কি ড্যানির সাথে ব্রেকআপ করেছিস।আমার তো তোর আচার-আচরণ সুবিধার ঠেকছে না।ড্যানি কি এমন করেছে?
তোর কাছে ভালোবাসা মানে কি?
ভালোবাসা? 
থাক বলতে হবে না শুধুই শারীরিক চাহিদা মাত্র। তোর মতো চিন্তা ধারা আমারও ছিলো কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি আমি ভুল ছিলাম।ভালোবাসা মানে হলো সহযোদ্ধা, এক সাথে এক সঙ্গে জীবনের প্রত্যেকটি মূহুর্ত কাটিয়ে দেওয়া।সুখ হোক বা দুঃখ সব একসাথে ভাগ করে নেওয়া।তুই জিজ্ঞেস করলি না ওর কি দোষ,ওর একটাই দোষ ও হলো সৌন্দর্যের পূজারী।আজ আমার রুপে পাগল পরে অন্য রুপে পাগল হবে।থাক আর কথা না বাড়াই।
ঐযে সাদা রংয়ের বাড়িটি সোফিয়ার।

তুমি সোফিয়া?
হ্যাঁ ,আপনি কে?
আমি কোন কথা না বলেই সোফিয়ার হাতে চিঠিগুলো দিলাম। সোফিয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে চিঠির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ পর সে বলল, এ চিঠি গুলো আরো এক বছর আগের।
আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে কি বলছে।
হা চিঠি গুলো পুরনো এমনকি চিঠির লেখক ও আজ পুরনো। চিঠিগুলো সে যখন লিখেছিল তখন চিঠিগুলো আমি পাইনি কিন্তু চিঠির লেখক এর সাথে দেখা হয়েছিল আমার।দিনটি ছিল সোমবার। সে আমাকে চিঠির কথা বলল, কিন্তু আমি তাকে পাগল উন্মাদ বলে গালাগালি দিলাম এবং সতর্ক করলাম আমার পিছু না নিতে।সে হতাশ হয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমি তাকে পাগল ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ঠিক ছিলো শুধু আমিই তাকে চিনতে পারিনি বা চিনতে পারার কথাও ছিল না।

সোফিয়া চিঠির লেখক ও আজ পুরোনো বলতে তুমি কি বুঝাচ্ছো?
ছেলেটির নিথর দেহ আমি দেখেছি, ছেলেটি আত্মহত্যা করেছিল শুধুমাত্র আমার জন্য। এজন্যই আমি চের্ক্যাসি ছেড়ে
কিয়েভে চলে আসলাম। ওখানে থাকতে আমার নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন আমিই ওকে খুন করেছি। কিন্তু কি করতাম বলো ওর চিঠিগুলো কখনো আমার কাছে আসেনি। তাই আমি ওকে চিনতেও পারিনি।

আমি সোফিয়ার সাথে আর কোন কথা বাড়ালাম না।এলিনা ওর সাথে কথা বলছে।আমি ওদের কে উপেক্ষা করে স্থান ত্যাগ করলাম।এলিনা আমায় ডাকছিলো আমি ওর কথায় কর্ণপাত না করে একলা আমি চের্ক্যাসিতে চলে এলাম।
আজ পরিবেশটা খুব শান্ত মনে হচ্ছে প্রচন্ড ঝড় আসবে, হালকা শীতল হাওয়া আমার শরীরে বয়ে যাচ্ছে। আজ তুষার পড়বে, প্রচণ্ড তুষার পড়বে। তুষারে ঢাকা পড়বে এই শহরটা। আজ বৃষ্টি পড়লে মন্দ হত না কিন্তু আজ বৃষ্টি পড়বে না কারণ আজ তুষারের দিন। আমি ঘরে প্রবেশ করতেই চোখে লাগলো সাদা একটি খাম ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে। আমি চিঠি পড়তে লাগলাম, আবছা অন্ধকারে চিঠিটি আমার কাছে ঝাপসা লাগলো তবুও আমি পড়ছিলাম। শুরুতেই সেই একই বাক্য প্রিয় সোফিয়া! কিন্তু আজ আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রিয় সোফিয়া টা লেখা নেই শুধু একটি বাক্যই লেখা সারা চিঠি জুড়ে,

" প্রিয় মার্গারেট!"

 

                            (সমাপ্ত) 





Comments

Popular Posts